সিজোফ্রেনিয়া একটি গুরুতর মানসিক রোগ যা মানুষের চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণকে প্রভাবিত করে। এটি একটি জটিল রোগ এবং এর কারণ এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি। তবে জিনগত, পরিবেশগত এবং মস্তিষ্কের রাসায়নিক উপাদানের ভারসাম্যহীনতা এর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

সিজোফ্রেনিয়া কি?

সিজোফ্রেনিয়া একটি স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন এক প্রকার দীর্ঘস্থায়ী মানসিক জটিল ব্যাধি।

এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী মানসিক ব্যাধি যা বাস্তবতাকে বিকৃতভাবে উপলব্ধি করতে বাধ্য করে। এর ফলে রোগীর চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এটি সাধারণত কৈশোরের শেষ দিকে বা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের শুরুতে (পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৮-২৫ বছর, মহিলাদের ক্ষেত্রে ২৫-৩৫ বছর) প্রকাশ পায়।

সিজোফ্রেনিয়ার কারণ

সিজোফ্রেনিয়ার সঠিক কারণ এখনো অজানা, তবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো এর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়:
জিনগত প্রবণতা (Genetic predisposition): পরিবারে কারও সিজোফ্রেনিয়া থাকলে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
মস্তিষ্কের গঠন ও রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা (Brain chemistry and structure): মস্তিষ্কের ডোপামিন, গ্লুটামেট ইত্যাদি নিউরোট্রান্সমিটারের (রাসায়নিক বার্তাবাহক) ভারসাম্যহীনতা এবং মস্তিষ্কের কিছু অংশের গঠনে অস্বাভাবিকতা দেখা যেতে পারে।
পরিবেশগত কারণ (Environmental factors): গর্ভাবস্থায় মায়ের অপুষ্টি বা ভাইরাস সংক্রমণ, প্রসবকালীন জটিলতা, শৈশবে মানসিক আঘাত বা অবহেলা, মানসিক চাপ, ইত্যাদি।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার (Substance abuse): গাঁজা, কোকেন, অ্যামফিটামিন ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সিজোফ্রেনিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে বা উপসর্গের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে।

বিভিন্ন রকমের অ্যালকোহল সেবন করলে সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার বা মানসিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।মাথায় আঘাত লাগার কারণে সিজোফ্রেনিয়া বা মানসিক সমস্যা হতে পারে।যদি কোন মানুষ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে বা ঘরের ভিতরে বন্দী হয়ে থাকে। একাকী হয়ে থাকে। তাহলে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। গর্ভ অবস্থায় বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলে মানসিক রোগ হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে আরেকটি সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ছোট বাচ্চাদেরকে বডিংয়ে রেখে আসা বা এতিমখানায় ,মাদ্রাসায় সাধারণত দেখা যায় জিজ্ঞাসা করলে বাচ্চারা বলে ওঠে যে আমার বাবা-মা আমাকে রেখে বাড়িতে চলে গেছে এই ধরনের বাচ্চাদের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা 90 শতাংশ তাই আমাদের গণসচেতনতা একান্ত জরুরী দরকার।

সিজোফ্রেনিয়ার রোগ নির্ণয়:

সিজোফ্রেনিয়া নির্ণয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ল্যাবরেটরি পরীক্ষা নেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীর আচরণ, লক্ষণ এবং পারিবারিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করেন। সাধারণত DSM-5 (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition) বা ICD (International Classification of Diseases) এর নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়। রোগ নির্ণয়ের জন্য লক্ষণগুলো কমপক্ষে এক মাস ধরে উপস্থিত থাকতে হবে এবং অন্তত ছয় মাস ধরে রোগের কিছু লক্ষণ বজায় থাকতে হবে।

সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ

রোগী একাকী থাকতে চায় সে কারো সাথে মিশতে চায়না। ভুল কাজ করাকে সঠিক মনে করে যেকোনো কাজ যদি সেটা ভুল হয় সেটা সত্য মনে করবে।

কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলে সহসায় সে উত্তর দেয় না এবং হাঁ করে চেয়ে থাকে তার দিকে। কাউকেই বিশ্বাস করতে চায় না সবাইকে শত্রু মনে করেন।

নিজের পেশা সম্পর্কে আগ্রহ হারাই ফেলে তার নিজের কোন কাজ করতে মনে চায় না বা করতে গেলে ভুলে যায়। রোগী মনে করে তাকে কোনো পুলিশ খুজতেছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কোন মানুষ তাকে গালাগালি করে বা কোনো কারণ ছাড়াই মানুষকে গালাগালি করে এবং দুর্ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করে না। সকল প্রকার সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব থেকে বিরত থাকে সে কোন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে চায় না।

সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণসমূহ আরো একটু বুঝায়াইয়া লেখা হলো:

সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলোকে কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:
১. পজিটিভ লক্ষণ (Positive Symptoms): এই লক্ষণগুলো স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার অতিরিক্ত বা বিকৃত প্রকাশ।

  • হ্যালুসিনেশন (Hallucinations): এমন কিছু দেখা, শোনা, গন্ধ পাওয়া, স্বাদ নেওয়া বা স্পর্শ অনুভব করা যা বাস্তবে নেই। সবচেয়ে সাধারণ হলো auditary hallucination বা গায়েবি আওয়াজ শোনা (যেমন কেউ কথা বলছে, নির্দেশ দিচ্ছে বা সমালোচনা করছে)।
  • ডিলিউশন (Delusions): দৃঢ়, মিথ্যা বিশ্বাস যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং যুক্তিতর্ক দিয়েও পরিবর্তন করা যায় না। যেমন:
  • পারসিকিউটরি ডিলিউশন (Persecutory delusion): বিশ্বাস করা যে কেউ তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে, তাকে অনুসরণ করছে বা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
  • গ্র্যান্ডিওস ডিলিউশন (Grandiose delusion): নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষমতাবান বা বিশেষ কেউ বলে মনে করা।
  • রেফারেন্সিয়াল ডিলিউশন (Referential delusion): মনে করা যে চারপাশের সাধারণ ঘটনা, মন্তব্য বা সংবাদ তার উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে।
  • অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা ও কথাবার্তা (Disorganized thinking and speech): কথা বলার সময় বিষয়বস্তু ঠিক না থাকা, অগোছালো বা অর্থহীন কথা বলা, এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে দ্রুত চলে যাওয়া।
  • অস্বাভাবিক আচরণ (Disorganized or catatonic behavior): কাজকর্ম এলোমেলো হওয়া, লক্ষ্যহীন আচরণ করা, অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করা, অথবা একেবারেই নড়াচড়া না করা (ক্যাটাটোনিয়া)।
    ২. নেগেটিভ লক্ষণ (Negative Symptoms): এই লক্ষণগুলো স্বাভাবিক আবেগ এবং আচরণের অনুপস্থিতি বা হ্রাস বোঝায়।
  • আবেগ প্রকাশের অভাব (Flat affect): মুখমণ্ডলে আবেগের অভিব্যক্তি কমে যাওয়া, কণ্ঠস্বরে আবেগ না থাকা।
  • অ্যানহেডোনিয়া (Anhedonia): কোনো কিছুতে আনন্দ না পাওয়া, আগে যা ভালো লাগত এখন তা লাগে না।
  • অ্যাভোলিশন (Avolition): ইচ্ছাশক্তি বা অনুপ্রেরণার অভাব, কোনো কাজ শুরু করতে বা চালিয়ে যেতে অসুবিধা।
  • অ্যালোজিয়া (Alogia): কথা কমে যাওয়া বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে না পারা।
  • অ্যাসোশিয়ালিটি (Asociality): সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলা, একা থাকতে পছন্দ করা।
    ৩. কগনিটিভ বা জ্ঞানীয় লক্ষণ (Cognitive Symptoms): এই লক্ষণগুলো চিন্তাভাবনা এবং স্মৃতিশক্তির সাথে সম্পর্কিত।
  • মনোযোগ দিতে অসুবিধা।
  • সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা।
  • তথ্য মনে রাখতে বা ব্যবহার করতে অসুবিধা।
  • কার্যনির্বাহী ক্ষমতার সমস্যা (যেমন পরিকল্পনা করা, সংগঠিত করা)।

সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসা

সিজোফ্রেনিয়া একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ হলেও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং রোগী অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। চিকিৎসা সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে:

১. ওষুধ (Medications):

  • অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ (Antipsychotic medications): এগুলি সিজোফ্রেনিয়ার প্রধান চিকিৎসা। এটি হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন এবং অসংলগ্ন চিন্তাভাবনার মতো পজিটিভ লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ রয়েছে (যেমন: টিপিক্যাল এবং অ্যাটিপিক্যাল)। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করেন।

২. মনোসামাজিক চিকিৎসা (Psychosocial therapies):

  • সাইকোথেরাপি (Psychotherapy): যেমন কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (CBT) রোগীকে তার চিন্তা ও আচরণের ধরণ বুঝতে এবং তা পরিবর্তন করতে সাহায্য করে।
  • পারিবারিক থেরাপি (Family therapy): পরিবারের সদস্যদের রোগটি সম্পর্কে শিক্ষিত করা এবং রোগীর পরিচর্যায় তাদের সহায়তা করার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
  • সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ (Social skills training): যোগাযোগ এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করে।
  • বৃত্তিমূলক পুনর্বাসন (Vocational rehabilitation): রোগীকে কর্মজীবনে ফিরে যেতে বা নতুন কাজ খুঁজে পেতে সহায়তা করে।
    ৩. সহায়তা ও সমর্থন (Support):
  • পরিবার, বন্ধু এবং সামাজিক সহায়তা গোষ্ঠীর সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে উৎসাহিত করা।

উপবাস বা প্রতিদিন সাগর পাড়ে নিয়ে যাওয়া বা কোন মাঠে একাকী নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন জিনিস দেখানো। এ ধরনের রোগীদের জন্য একজন সাইকোলজিস্ট বা মনোবিজ্ঞান নিয়ে যারা লেখাপড়া করেছে তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া বা তাদেরকে দিয়ে সেবা-যত্ন করানো এবং অবশ্যই একজন মানসিক রোগে অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের গতি ও পরিণতি:

সিজোফ্রেনিয়ার পরিণতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়।
দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা শুরু করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
অনেকেই চিকিৎসার মাধ্যমে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক বা প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।
কিছু ক্ষেত্রে, রোগের প্রকোপ বেশি হতে পারে এবং ঘন ঘন রিল্যাপস (পুনরায় অসুস্থ হওয়া) হতে পারে।
নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং থেরাপি চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের ভুল ধারণা:

সিজোফ্রেনিয়া মানে মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার (Multiple Personality Disorder) নয়: এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রোগ।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত সবাই বিপজ্জনক বা হিংস্র হয় না: সঠিক চিকিৎসায় থাকলে তারা সমাজের জন্য কোনো হুমকি নয়। বরং তারা নিজেরাই অনেক সময় ভুক্তভোগী হন।

কখন ডাক্তার দেখাবেন:

যদি আপনার বা আপনার পরিচিত কারও মধ্যে উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলো (বিশেষ করে হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন, অসংলগ্ন কথাবার্তা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা) দেখা যায়, তাহলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করলে জটিলতা কমানো যায় এবং আরোগ্যের সম্ভাবনা বাড়ে।
সিজোফ্রেনিয়া একটি গুরুতর রোগ, তবে হতাশ না হয়ে সঠিক চিকিৎসা ও সহায়তার মাধ্যমে এর মোকাবেলা করা সম্ভব।

আমাদের চিকিৎসা প্যাকেজ নিন

হোমিও ওষুধের নাম ও কাজ, চিকিৎসা, খাওয়ার নিয়ম।

Please subscribe to my channel and follow

Facebook Page

YouTube

Translate »