রোগী লিপি বা রোগীর মেডিকেল রেকর্ড তৈরি করা চিকিৎসা পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি রোগীর স্বাস্থ্য ইতিহাস, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা, এবং ফলো-আপ তথ্যের একটি বিস্তারিত নথি হিসেবে কাজ করে। নিচে এর একটি সাধারণ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
১. রোগীর মৌলিক তথ্য সংগ্রহ:
- রোগীর নাম, বয়স, লিঙ্গ, জন্ম তারিখ।
- ঠিকানা, যোগাযোগের তথ্য (ফোন নম্বর, ইমেল)।
- পেশা।
- জরুরি অবস্থার জন্য যোগাযোগের তথ্য (কারও নাম ও ফোন নম্বর)।
২. প্রধান অভিযোগ (Chief Complaint – CC):
- রোগী কী সমস্যা নিয়ে এসেছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
- রোগীর নিজের ভাষায় সমস্যাটি নথিভুক্ত করা। উদাহরণ: “পেটে ব্যথা”, “জ্বর”, “শ্বাসকষ্ট”।
৩. বর্তমান রোগের ইতিহাস (History of Present Illness – HPI):
- প্রধান অভিযোগটি কখন শুরু হয়েছিল?
- এটি ধীরে ধীরে না হঠাৎ করে শুরু হয়েছে?
- ব্যথার ধরন, তীব্রতা, স্থান, এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য উপসর্গ।
- কী কী বিষয় উপসর্গ বাড়ায় বা কমায়?
- এর জন্য কী চিকিৎসা নেওয়া হয়েছে (যদি থাকে)?
৪. পূর্ববর্তী চিকিৎসার ইতিহাস (Past Medical History – PMH):
- রোগীর পূর্বে কোনো বড় ধরনের অসুস্থতা (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, হৃদরোগ) ছিল কি না।
- কোনো অপারেশন বা হাসপাতালে ভর্তির ইতিহাস।
- বর্তমানে কোনো ওষুধ সেবন করছেন কি না এবং তার বিস্তারিত তথ্য (ওষুধের নাম, ডোজ, সেবনের কারণ)।
- কোনো অ্যালার্জি আছে কি না (ওষুধ, খাবার, বা অন্য কিছুতে)।
- টিকা গ্রহণের ইতিহাস।
৫. পারিবারিক ইতিহাস (Family History – FH):
- পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের (বাবা, মা, ভাই, বোন) মধ্যে একই ধরনের বা বংশগত রোগের ইতিহাস আছে কি না। উদাহরণ: ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার।
৬. সামাজিক ইতিহাস (Social History – SH):
- রোগীর ধূমপান, মদ্যপান বা অন্যান্য মাদকের অভ্যাস আছে কি না।
- জীবনযাত্রার ধরন, খাদ্যভ্যাস, ব্যায়ামের অভ্যাস।
- পেশাগত ঝুঁকি (যদি থাকে)।
৭. শারীরিক পরীক্ষা (Physical Examination – PE):
*রোগীর উচ্চতা, ওজন, রক্তচাপ, পালস, শ্বাস-প্রশ্বাস, শরীরের তাপমাত্রা।
*মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি সিস্টেমের পরীক্ষা:
- সাধারণ পরিদর্শন: রোগীর সামগ্রিক চেহারা, পুষ্টির অবস্থা।
- মাথা, চোখ, কান, নাক, গলা (HEENT): লিম্ফ নোড, থাইরয়েড।
- বুক ও ফুসফুস: শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।
- হৃৎপিণ্ড: হার্টের শব্দ।
- পেট: স্পর্শ, ব্যথা, ফোলা।
- স্নায়ুতন্ত্র: রিফ্লেক্স, সংবেদন।
- মাস্কুলোস্কেলেটাল সিস্টেম: জয়েন্ট, পেশী।
- ত্বক: ফুসকুড়ি, ক্ষত।
৮. গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ
- অদ্ভুত ও অসাধারণ লক্ষণ
- মানসিক ও শারীরিক
৯. প্রাথমিক রোগ নির্ণয় (Provisional Diagnosis):
- সংগৃহীত তথ্য এবং শারীরিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সম্ভাব্য রোগ নির্ণয়।
১০. প্রস্তাবিত পরীক্ষা (Investigations/Labs):
- রোগ নির্ণয়ের নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাব পরীক্ষা (রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা) বা ইমেজিং পরীক্ষা (এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান)।
১১. চিকিৎসা পরিকল্পনা (Treatment Plan):
- ওষুধপত্র (ওষুধের নাম, ডোজ, সেবনের নিয়ম)।
- জীবনযাত্রার পরিবর্তন (খাদ্য, ব্যায়াম)।
- রেফারেল (বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর প্রয়োজন হলে)।
- ফলো-আপের তারিখ।
১২. রোগীর সম্মতি (Informed Consent):
- কোনো প্রক্রিয়া বা চিকিৎসার আগে রোগীর কাছ থেকে মৌখিক বা লিখিত সম্মতি নেওয়া।
১৩. তারিখ ও স্বাক্ষর:
- প্রতিটি এন্ট্রির সাথে তারিখ এবং লিপিবদ্ধকারীর নাম ও স্বাক্ষর।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- সঠিকতা ও স্পষ্টতা: সকল তথ্য সঠিক এবং স্পষ্টভাবে লেখা উচিত।
- গোপনীয়তা: রোগীর তথ্য গোপন রাখা অত্যন্ত জরুরি।
- নিয়মিত আপডেট: রোগীর অবস্থার পরিবর্তন হলে বা নতুন তথ্য পাওয়া গেলে তা নিয়মিতভাবে লিপিতে আপডেট করা।
- ডিজিটাল বনাম হাতে লেখা: বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবহার করে, যা তথ্য সংরক্ষণ ও অ্যাক্সেস করা সহজ করে।