সুষম খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা
সুষম খাদ্য কী?
সুষম খাদ্য বলতে বোঝায় এমন এক ধরনের খাদ্যাভ্যাস যেখানে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান, যেমন – শর্করা (কার্বোহাইড্রেট), আমিষ (প্রোটিন), স্নেহ পদার্থ (ফ্যাট), ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং পানি সঠিক পরিমাণে ও অনুপাতে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
পুষ্টি উপাদান ও তাদের কাজ:
শর্করা (Carbohydrates): আমাদের শরীরের শক্তির প্রধান উৎস। শস্য জাতীয় খাবার (চাল, গম, ভুট্টা), আলু, ফলমূল ইত্যাদি থেকে আমরা শর্করা পাই।
আমিষ (Protein): দেহ গঠন, ক্ষয়পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে অপরিহার্য। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, বাদাম ইত্যাদি আমিষের ভালো উৎস।
স্নেহ পদার্থ (Fats/Lipids): শক্তি সরবরাহ করে, শরীরে তাপ উৎপন্ন করে এবং ভিটামিন (এ, ডি, ই, কে) শোষণে সাহায্য করে। স্বাস্থ্যকর স্নেহ পদার্থের জন্য উদ্ভিজ্জ তেল, বাদাম, মাছের তেল ইত্যাদি গ্রহণ করা উচিত।
ভিটামিন (Vitamins): শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে এবং রোগ প্রতিরোধে ভিটামিনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রকার ফল ও শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন পাওয়া যায়।
খনিজ লবণ (Minerals): যেমন ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, পটাশিয়াম ইত্যাদি শরীরের গঠন, স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতা এবং বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য অপরিহার্য। দুধ, ডিম, সবুজ শাকসবজি, ফল ইত্যাদি খনিজ লবণের উৎস।
পানি (Water): শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টি উপাদান পরিবহন, বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন এবং কোষের গঠন বজায় রাখার জন্য পানি অত্যাবশ্যক। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত।
খাদ্য আঁশ (Dietary Fiber): হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফল, সবজি, ডাল ও আটা জাতীয় খাবারে আঁশ পাওয়া যায়।
সকল প্রকার ভিটামিন ও খনিজ সম্পর্কে বিস্তারিত
চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন (Fat-Soluble Vitamins)
এই ভিটামিনগুলো চর্বিতে দ্রবীভূত হয় এবং লিভার ও ফ্যাটি টিস্যুতে সঞ্চিত থাকে। এই কারণে, এগুলি অতিরিক্ত গ্রহণ করলে শরীরে জমা হয়ে বিষক্রিয়া বা টক্সিসিটি (Toxicity) তৈরি করতে পারে।
ভিটামিন এ (Vitamin A)
বিস্তারিত কাজ: ভিটামিন এ, যা রেটিনল নামেও পরিচিত, চোখের রেটিনার রড কোষ গঠনে সাহায্য করে, যা কম আলোতে দেখতে অপরিহার্য। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শ্বেত রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়তা করে এবং কোষের বৃদ্ধি ও বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উৎস: এর দুটি প্রধান রূপ রয়েছে: প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া রেটিনল এবং উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে পাওয়া বিটা-ক্যারোটিন (যা শরীরে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়)। প্রধান উৎসগুলো হলো: কলিজা, মাছের তেল, ডিমের কুসুম, দুধ, মাখন, গাজর, মিষ্টি আলু, পালং শাক, আম এবং কুমড়া।
অভাবজনিত লক্ষণ: এর অভাবে প্রথমে রাতকানা রোগ (Nyctalopia) হয়। দীর্ঘস্থায়ী অভাবে চোখের কর্নিয়া শুকিয়ে যায় (Xerophthalmia), যা থেকে অন্ধত্বও হতে পারে। এছাড়া ত্বকের শুষ্কতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং শিশুদের বৃদ্ধিতে বাধা দেখা যায়।
অতিরিক্ত গ্রহণের ফল: অতিরিক্ত ভিটামিন এ গ্রহণে হাইপারভিটামিনোসিস এ (Hypervitaminosis A) হতে পারে, যার ফলে মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, বমি বমি ভাব, লিভারের ক্ষতি এবং হাড়ের ব্যথা হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত ভিটামিন এ গ্রহণ ক্ষতিকর হতে পারে।
ভিটামিন ডি (Vitamin D)
বিস্তারিত কাজ: এর প্রধান কাজ হলো রক্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, যা হাড়ের গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অপরিহার্য। এটি অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ এবং কোষের বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে।
উৎস: সূর্যের আলো ত্বকে লাগলে শরীর ভিটামিন ডি৩ (Cholecalciferol) তৈরি করতে পারে। এছাড়া তৈলাক্ত মাছ (স্যামন, টুনা), মাছের তেল, ডিমের কুসুম, এবং ভিটামিন ডি ফোর্টিফাইড দুধ ও সিরিয়াল এর ভালো উৎস।
অভাবজনিত লক্ষণ: শিশুদের ক্ষেত্রে এর অভাবে রিকেটস রোগ হয়, যেখানে হাড় নরম ও বাঁকা হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে অস্টিওম্যালেসিয়া হয়, যার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যথা হয়। এছাড়াও মাংসপেশির দুর্বলতা এবং ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত গ্রহণের ফল: অতিরিক্ত ভিটামিন ডি গ্রহণে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে (Hypercalcemia), যা বমি বমি ভাব, দুর্বলতা, কিডনিতে পাথর এবং হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর ক্ষতি করতে পারে।
ভিটামিন ই (Vitamin E)
বিস্তারিত কাজ: ভিটামিন ই একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি কোষকে ফ্রি র্যাডিক্যাল নামক ক্ষতিকর অণুর হাত থেকে রক্ষা করে, যা কোষের ক্ষতি করে এবং বার্ধক্য ও বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। এটি রক্তনালীকে সুস্থ রাখতে এবং রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
উৎস: উদ্ভিজ্জ তেল (সূর্যমুখী, সয়াবিন), বাদাম (আমন্ড), বীজ (সূর্যমুখীর বীজ), সবুজ শাকসবজি (পালং শাক, ব্রকলি) এর প্রধান উৎস।
অভাবজনিত লক্ষণ: ভিটামিন ই-এর অভাব খুব বিরল। তবে এর অভাবে পেশির দুর্বলতা, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এটি সাধারণত হজমের সমস্যা বা চর্বি শোষণ করতে পারে না এমন রোগীদের মধ্যে দেখা যায়।
অতিরিক্ত গ্রহণের ফল: ভিটামিন এ বা ডি-এর মতো এটি ততটা বিষাক্ত না হলেও, খুব বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ভিটামিন কে (Vitamin K)
বিস্তারিত কাজ: এর প্রধান কাজ হলো রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন (Prothrombin) তৈরি করা। কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য এটি অপরিহার্য। এছাড়া এটি হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং ক্যালসিয়ামের সঠিক ব্যবহারে সহায়তা করে।
উৎস: এর দুটি প্রধান রূপ হলো K1 (Phylloquinone) ও K2 (Menaquinone)। K1 সবুজ শাক-সবজিতে (পালং শাক, কেল, ব্রকলি) এবং K2 প্রাণিজ উৎস (কলিজা, ডিম) ও ফারমেন্টেড খাবারে পাওয়া যায়।
অভাবজনিত লক্ষণ: এর অভাবে রক্ত সহজে জমাট বাঁধে না, ফলে সামান্য আঘাতেই অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে। নবজাতকদের মধ্যে এর অভাব বেশি দেখা যায়, তাই তাদের জন্মের সময় ভিটামিন কে ইনজেকশন দেওয়া হয়।
অতিরিক্ত গ্রহণের ফল: প্রাকৃতিক ভিটামিন কে (K1, K2) থেকে বিষক্রিয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কৃত্রিম ভিটামিন কে (K3 বা Menadione) বেশি মাত্রায় গ্রহণ করলে লিভারের ক্ষতি হতে পারে।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন (Water-Soluble Vitamins)
এই ভিটামিনগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং শরীর প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ মূত্রের মাধ্যমে বের করে দেয়। তাই শরীরে এদের মাত্রা সঠিক রাখতে প্রতিদিন খাবারের মাধ্যমে এগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ভিটামিন সি (Vitamin C)
বিস্তারিত কাজ: এটি কোলাজেন নামক প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে, যা ত্বক, রক্তনালী, হাড় এবং তরুণাস্থি (Cartilage) গঠনে অপরিহার্য। এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও এটি ক্ষত নিরাময় এবং আয়রন শোষণে সহায়তা করে।
উৎস: টক জাতীয় ফল (লেবু, কমলা, জাম্বুরা), আমলকী, পেয়ারা, স্ট্রবেরি, কিউই, ব্রকলি, এবং ক্যাপসিকাম এর চমৎকার উৎস।
অভাবজনিত লক্ষণ: এর তীব্র অভাবে স্কার্ভি (Scurvy) রোগ হয়, যার ফলে মাড়ি ফুলে যাওয়া ও রক্ত পড়া, ক্লান্তি, জয়েন্টে ব্যথা এবং সহজে ত্বকে কালশিটে দাগ পড়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
অতিরিক্ত গ্রহণের ফল: ভিটামিন সি সাধারণত নিরাপদ, তবে অতিরিক্ত মাত্রায় (২০০০ মিলিগ্রামের বেশি) গ্রহণ করলে ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব এবং পেটে ব্যথার মতো হজমের সমস্যা হতে পারে।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (Vitamin B Complex)
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আটটি ভিন্ন ভিটামিনের সমষ্টি। এরা প্রধানত খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে এবং মেটাবলিজম বা বিপাকক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে।
- ভিটামিন বি১ (থায়ামিন): কার্বোহাইড্রেট থেকে শক্তি তৈরিতে অপরিহার্য। এটি স্নায়ুতন্ত্র ও হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এর অভাবে বেরিবেরি (Beriberi) রোগ হয়, যা স্নায়ুতন্ত্র ও হৃৎপিণ্ডকে প্রভাবিত করে।
- ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাভিন): শক্তি উৎপাদন এবং কোষের বৃদ্ধি ও কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজন। এর অভাবে মুখে ও জিহ্বায় ঘা, ত্বকের সমস্যা এবং চোখ লাল হয়ে যেতে পারে।
- ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন): খাদ্য থেকে শক্তি উৎপাদনে এবং স্নায়ুতন্ত্র ও হজম প্রক্রিয়াকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এর অভাবে পেলেগ্রা (Pellagra) রোগ হয়, যার ফলে ডার্মাটাইটিস, ডায়রিয়া ও ডিমেনশিয়া দেখা দেয়।
- ভিটামিন বি৫ (প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড): প্রায় সব খাবারেই অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়। এটি শক্তি উৎপাদন এবং হরমোন ও কোলেস্টেরল তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এর অভাব অত্যন্ত বিরল।
- ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন): অ্যামিনো অ্যাসিডের বিপাক, লোহিত রক্তকণিকা গঠন এবং নিউরোট্রান্সমিটার (মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তা) তৈরিতে অপরিহার্য। এর অভাবে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা, ত্বকের সমস্যা এবং বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে।
- ভিটামিন বি৭ (বায়োটিন): কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট এবং প্রোটিনের বিপাকে সহায়তা করে। চুল, ত্বক ও নখের স্বাস্থ্য রক্ষায় এর ভূমিকা রয়েছে। এর অভাব বিরল, তবে হলে চুল পড়া ও ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- ভিটামিন বি৯ (ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড): নতুন কোষ তৈরি এবং ডিএনএ (DNA) সংশ্লেষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এটি অপরিহার্য, কারণ এটি গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের জন্মগত ত্রুটি (Neural Tube Defects) প্রতিরোধ করে। এর অভাবে মেগালোব্লাস্টিক অ্যানিমিয়া হতে পারে।
- ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন): লোহিত রক্তকণিকা তৈরি এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য এটি অপরিহার্য। এটি মূলত প্রাণিজ খাদ্যে (মাছ, মাংস, ডিম, দুধ) পাওয়া যায়। এর অভাবে মারাত্মক রক্তশূন্যতা এবং স্নায়ুতন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। নিরামিষাশীদের মধ্যে এর অভাবের ঝুঁকি বেশি থাকে।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের উৎস: ঢেঁকিছাঁটা চাল, আটা, ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, সবুজ শাকসবজি এবং বিভিন্ন ধরণের ডালে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স পাওয়া যায়।
মানবদেহে খনিজের ভূমিকা
মানবদেহের গঠন, বৃদ্ধি এবং সুস্থতার জন্য খনিজ পদার্থ অত্যাবশ্যক। যদিও শরীরের মোট ওজনের মাত্র ৪ শতাংশ খনিজ পদার্থ দ্বারা গঠিত, কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম। ভিটামিন, প্রোটিন বা কার্বোহাইড্রেটের মতো খনিজ পদার্থ শক্তি উৎপাদন না করলেও, দেহের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে এদের ভূমিকা ছাড়া শরীর অচল। হাড় ও দাঁত গঠন থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় খনিজ অপরিহার্য।
শরীরে প্রয়োজনীয়তার পরিমাণের উপর ভিত্তি করে খনিজ পদার্থকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়:
- ম্যাক্রোমিনারেলস (Macrominerals): এই খনিজগুলো শরীরে বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয়।
- ট্রেস মিনারেলস (Trace Minerals): এই খনিজগুলো খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হলেও শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাক্রোমিনারেলস: দেহের মূল ভিত্তি
শরীরের প্রধান গঠন এবং কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে ম্যাক্রোমিনারেলস মুখ্য ভূমিকা পালন করে। নিচে প্রধান পাঁচটি ম্যাক্রোমিনারেল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. ক্যালসিয়াম (Calcium)
কাজ: মানবদেহের প্রায় ৯৯% ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতে জমা থাকে, যা এদের গঠন ও মজবুতির জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও, রক্ত জমাট বাঁধা, পেশী সংকোচন, স্নায়ুতন্ত্রের সংকেত প্রেরণ এবং বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণে ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অভাবজনিত সমস্যা: ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুদের রিকেটস (হাড় নরম ও বেঁকে যাওয়া) এবং প্রাপ্তবয়স্কদের অস্টিওপোরোসিস (হাড় ভঙ্গুর) রোগ হয়। এছাড়া পেশিতে খিঁচুনি এবং হাড় ও দাঁতের দুর্বলতা দেখা দেয়।
খাদ্য উৎস: দুধ, দই, পনিরের মতো দুগ্ধজাত খাবার, কাঁটাসহ ছোট মাছ, সবুজ শাকসবজি (পালংশাক, শজনেপাতা), সয়াবিন, তিল, বাদাম এবং ডুমুর ক্যালসিয়ামের চমৎকার উৎস।
২. ফসফরাস (Phosphorus)
কাজ: ক্যালসিয়ামের সাথে মিলে হাড় ও দাঁতকে শক্তিশালী করে। এটি কোষের বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামত এবং ডিএনএ ও আরএনএ গঠনে সহায়তা করে। কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতেও এর ভূমিকা রয়েছে।
অভাবজনিত সমস্যা: এর অভাবে দাঁতের ক্ষয়, হাড়ের দুর্বলতা এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
খাদ্য উৎস: প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাংস, ডিম, মাছ, দুধ, ডাল, বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবারে প্রচুর ফসফরাস পাওয়া যায়।
৩. পটাশিয়াম (Potassium)
কাজ: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে পটাশিয়াম অপরিহার্য। এটি শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং স্নায়ু ও পেশীর সঠিক কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে।
অভাবজনিত সমস্যা: পটাশিয়ামের অভাবে উচ্চ রক্তচাপ, পেশীর দুর্বলতা, হৃদরোগ এবং মানসিক অবসাদ দেখা দিতে পারে।
খাদ্য উৎস: কলা, কমলা, ডাবের পানি, আলু, টমেটো, পালংশাক এবং বিভিন্ন ধরণের ডালে প্রচুর পটাশিয়াম রয়েছে।
৪. সোডিয়াম (Sodium)
কাজ: পটাশিয়ামের মতো সোডিয়ামও শরীরের জলীয় ভারসাম্য এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। পেশী ও স্নায়ুর কার্যকারিতা এর উপর নির্ভরশীল।
অভাবজনিত সমস্যা: এর অভাবে নিম্ন রক্তচাপ, মানসিক বিভ্রান্তি, দুর্বলতা এবং পেশিতে খিঁচুনি হতে পারে। তবে অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
খাদ্য উৎস: সাধারণ লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড), দুগ্ধজাত খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার সোডিয়ামের প্রধান উৎস।
৫. ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium)
কাজ: এটি ৩০০-এর বেশি এনজাইমকে সক্রিয় করে শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সাহায্য করে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পেশী ও স্নায়ুর কার্যকারিতা এবং ডিএনএ তৈরিতে ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন।
অভাবজনিত সমস্যা: এর অভাবে মাইগ্রেন, অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ এবং পেশিতে খিঁচুনি হতে পারে।
খাদ্য উৎস: সবুজ শাকসবজি, পূর্ণশস্যজাতীয় খাবার, বাদাম, বীজ, ডার্ক চকলেট এবং কলা ম্যাগনেসিয়ামের ভালো উৎস।
ট্রেস মিনারেলস: স্বল্প কিন্তু শক্তিশালী
এই খনিজগুলো অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হলেও এদের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. আয়রন বা লৌহ (Iron)
কাজ: রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য আয়রন অপরিহার্য, যা ফুসফুস থেকে অক্সিজেন শরীরের সমস্ত কোষে পৌঁছে দেয়।
অভাবজনিত সমস্যা: আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া হয়। এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, ক্লান্তি, মাথাব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
খাদ্য উৎস: লাল মাংস, কলিজা, ডিম, সবুজ শাকসবজি, ডাল, বিট এবং কিশমিশ আয়রনের ভালো উৎস।
২. জিঙ্ক বা দস্তা (Zinc)
কাজ: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে জিঙ্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। এটি ক্ষত সারাতে, কোষের বৃদ্ধিতে এবং স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
অভাবজনিত সমস্যা: জিঙ্কের অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে ঘন ঘন ঠান্ডা-সর্দি লাগে। এছাড়া চুল পড়া, ত্বকের সমস্যা এবং শিশুদের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
খাদ্য উৎস: লাল মাংস, হাঁস-মুরগির মাংস, দুগ্ধজাত খাবার, বাদام, শিম এবং মিষ্টি কুমড়ার বীজে জিঙ্ক পাওয়া যায়।
৩. আয়োডিন (Iodine)
কাজ: থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা এবং থাইরয়েড হরমোন (যেমন থাইরক্সিন) তৈরির জন্য আয়োডিন অপরিহার্য। এই হরমোন শরীরের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
অভাবজনিত সমস্যা: আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড (Goiter) রোগ হয়, যেখানে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এর অভাবে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।
খাদ্য উৎস: আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ এবং শৈবাল আয়োডিনের প্রধান উৎস।
৪. সেলেনিয়াম (Selenium)
কাজ: এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যা কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। প্রজনন ক্ষমতা, থাইরয়েড হরমোনের বিপাক এবং ডিএনএ সংশ্লেষণেও এর ভূমিকা রয়েছে।
অভাবজনিত সমস্যা: এর অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং পেশী দুর্বল হতে পারে।
খাদ্য উৎস: সামুদ্রিক মাছ, মাংস, ডিম এবং বাদামে সেলেনিয়াম পাওয়া যায়।
৫. কপার বা তামা (Copper)
কাজ: লোহিত রক্তকণিকা এবং কোলাজেন (যা টিস্যু গঠনে সাহায্য করে) তৈরিতে কপারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটি আয়রন শোষণেও সাহায্য করে।
অভাবজনিত সমস্যা: এর অভাব বিরল, তবে হলে রক্তশূন্যতা এবং হাড়ের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
খাদ্য উৎস: কলিজা, সামুদ্রিক খাবার, বাদাম, বীজ এবং পূর্ণশস্যজাতীয় খাবারে কপার পাওয়া যায়।